মহাবিশ্বের বিশালতায় আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি একটি রহস্যময় ধাঁধা। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি একটি চমকপ্রদ আবিষ্কার করেছেন, যা আমাদের এই গ্যালাক্সি সম্পর্কে ধারণাকে আরও গভীর করছে। তারা জানিয়েছেন, মিল্কি ওয়েতে ‘কোল্ড সুপার-আর্থ’—এমন গ্রহ যারা তাদের তারা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে—আগে ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় থাকতে পারে। এই আবিষ্কার এসেছে অত্যাধুনিক গ্র্যাভিটেশনাল মাইক্রোলেন্সিং কৌশলের মাধ্যমে, যা দূরবর্তী গ্রহ শনাক্তকরণে বিপ্লব ঘটাচ্ছে।
নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে, মিল্কি ওয়ের প্রায় প্রতি চারটি তারার একটিতে এমন একটি সুপার-আর্থ থাকতে পারে, যারা তাদের তারার বাসযোগ্য অঞ্চলের বাইরে, ঠান্ডা ও দূরবর্তী কক্ষপথে ঘুরছে। এটি আমাদের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ এই গ্রহগুলো আমাদের সৌরজগতের গ্রহ বিন্যাসের সঙ্গে মিলে না, যা আমাদের মহাবিশ্বের গ্রহ গঠনের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
নামটি শুনে মনে হতে পারে এগুলো পৃথিবীর মতো সবুজ, জীবনসমৃদ্ধ গ্রহ। কিন্তু বাস্তবে, সুপার-আর্থ বলতে এমন গ্রহ বোঝায় যার ভর পৃথিবীর চেয়ে বেশি কিন্তু নেপচুনের চেয়ে কম। এগুলো পাথুরে গ্রহ হতে পারে, বা গ্যাসের পুরু আবরণে ঢাকা থাকতে পারে। এই নতুন আবিষ্কৃত সুপার-আর্থগুলো তাদের তারা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে, যেখানে তাপমাত্রা এত কম যে তরল পানির সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবুও, এদের গঠন ও সম্ভাব্য বায়ুমণ্ডল নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কৌতূহল অপরিসীম।
গ্র্যাভিটেশনাল মাইক্রোলেন্সিং কৌশলটি একটি মহাজাগতিক কৌশলের মতো কাজ করে। যখন একটি তারা বা গ্রহ পৃথিবী ও অন্য কোনো তারার মাঝ দিয়ে যায়, তখন তার মাধ্যাকর্ষণ দূরবর্তী তারার আলোকে বাঁকিয়ে বা বড় করে দেয়। এই আলোর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দূরের গ্রহ শনাক্ত করতে পারেন। এই গবেষণায় জাপানের OGLE (Optical Gravitational Lensing Experiment) এবং KMTNet-এর টেলিস্কোপ ব্যবহার করা হয়েছে, যা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই টেলিস্কোপগুলো মিলে একটি অতি সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।
এই গবেষণায় একটি নির্দিষ্ট সুপার-আর্থ শনাক্ত করা হয়েছে, যার কক্ষপথ তার তারা থেকে পৃথিবী-সূর্য দূরত্বের প্রায় দুই গুণ দূরে। এটি আমাদের সৌরজগতের মঙ্গল বা বৃহস্পতির কক্ষপথের মতো। এর আগে, বেশিরভাগ সুপার-আর্থ তাদের তারার খুব কাছে পাওয়া যেত, যেখানে তাপমাত্রা অত্যন্ত উচ্চ। কিন্তু এই দূরবর্তী, ঠান্ডা সুপার-আর্থগুলো আমাদের গ্রহ গঠনের মডেলকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, এই ধরনের গ্রহ মিল্কি ওয়েতে আগের অনুমানের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি হতে পারে।
আমরা ভেবেছিলাম, আমাদের সৌরজগৎ—যেখানে ছোট পাথুরে গ্রহ কাছে আর বড় গ্যাসীয় গ্রহ দূরে—মহাবিশ্বের একটি সাধারণ নমুনা। কিন্তু এই আবিষ্কার ইঙ্গিত দেয় যে অনেক তারকা-ব্যবস্থায় বৃহস্পতির মতো বিশাল গ্রহের বদলে দূরবর্তী সুপার-আর্থ থাকতে পারে। এটি গ্রহ গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে নতুন দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
এই ঠান্ডা সুপার-আর্থগুলোতে তরল পানি বা জীবনের সম্ভাবনা কম, কারণ এগুলো তাদের তারার বাসযোগ্য অঞ্চলের বাইরে। তবে এদের বায়ুমণ্ডল বা ভূতাত্ত্বিক গঠন জানা গেলে জীবনের প্রাথমিক রূপ বা অন্য ধরনের রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটি জানতে আরও পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
এই আবিষ্কার গ্রহ অনুসন্ধানের কৌশলকে আরও শক্তিশালী করছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখন নাসার ন্যান্সি গ্রেস রোমান স্পেস টেলিস্কোপের মতো উন্নত যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে আছেন, যা ২০২৭ সালে উৎক্ষেপণের পর মাইক্রোলেন্সিং কৌশল ব্যবহার করে আরও হাজার হাজার গ্রহ শনাক্ত করতে পারে। গবেষকদের একজন বলেছেন, “এটি যেন মহাবিশ্বের একটি নতুন দরজা খুলে গেছে। আমরা এখনও শুরুতেই আছি।”
এই আবিষ্কার আমাদের মিল্কি ওয়ের গ্রহ-সম্পদের বিশালতা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। হয়তো আমাদের গ্যালাক্সিতে লুকানো রয়েছে অসংখ্য গ্রহের গল্প, যা আমরা এখনও পড়তে শুরু করিনি।
Tags:
বিজ্ঞান জগৎ