দুই নক্ষত্রের অদ্ভুত একক জগতের গল্প

মহাকাশে কি সবাই একা? না! অনেক তারাই আছে যারা জোড়ায় জোড়ায় ঘোরে, প্রেমিক যুগলের মতো—ঘুরছে একে অপরকে কেন্দ্র করে। এটাই বাইনারি স্টার সিস্টেম! কিন্তু কেন এই জোড়া তারারা বিজ্ঞানীদের এতটা আকৃষ্ট করে? আর তারা কি শুধু জোড়ায় থাকে, নাকি করে আরও কিছু রহস্যময় কাজ? চলুন, আজ জানি সেই রহস্যময় জগতের গল্প!

প্রথমেই জেনে নিই, বাইনারি স্টার সিস্টেম আসলে কী? বাইনারি স্টার সিস্টেম হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে দুটি তারা মহাকর্ষীয় শক্তির মাধ্যমে একে অপরের চারপাশে কক্ষপথে ঘোরে। এরা একটি সাধারণ ভরকেন্দ্রের চারদিকে চক্কর দেয়। আমাদের সূর্য একটি একক তারা, কিন্তু মহাবিশ্বে প্রায় অর্ধেক তারাই এই বাইনারি বা একাধিক তারার সিস্টেমের অংশ। আকর্ষণীয়, তাই না?

এবার জানা যাক, বাইনারি স্টার সিস্টেম কত প্রকারের হয়। প্রধানত এদের চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়:

১. ভিজ্যুয়াল বাইনারি: এই তারাগুলো এতটাই কাছাকাছি থাকে যে, টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলে দুটি আলাদা তারা হিসেবে চোখে পড়ে। এদের কক্ষপথ সাধারণত বড় হয় এবং পর্যবেক্ষণ করা সহজ।

২. স্পেকট্রোস্কোপিক বাইনারি: এই তারাগুলো এত কাছাকাছি থাকে যে টেলিস্কোপে একটি তারা মনে হয়। কিন্তু স্পেকট্রোস্কোপ ব্যবহার করে তাদের আলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিবর্তনের মাধ্যমে দুটি তারার উপস্থিতি ধরা পড়ে।

৩. ইক্লিপসিং বাইনারি: এই সিস্টেমে দুটি তারা এমনভাবে ঘোরে যে একটি তারা মাঝে মাঝে অন্যটির সামনে চলে আসে, ফলে আমাদের কাছে তাদের উজ্জ্বলতা কমে যায়। এটি দেখতে অনেকটা সূর্যগ্রহণের মতো!

৪. অ্যাস্ট্রোমেট্রিক বাইনারি: এখানে একটি তারা দৃশ্যমান, কিন্তু অন্যটি হয়তো খুব ক্ষীণ বা অদৃশ্য। কিন্তু দৃশ্যমান তারার গতিপথে অস্বাভাবিক কম্পন দেখে আমরা বুঝতে পারি, সেখানে আরেকটি তারা আছে।

কিন্তু এই বাইনারি স্টার সিস্টেমগুলো গঠিত হয় কীভাবে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, তারারা একই গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘ থেকে জন্ম নেয়। এই মেঘ যখন সংকুচিত হয়, তখন এটি একাধিক টুকরোয় ভাগ হয়ে যেতে পারে। প্রতিটি টুকরো থেকে একটি করে তারা তৈরি হয়, এবং মহাকর্ষের কারণে তারা একে অপরের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। কখনো কখনো, দুটি আলাদা তারা মহাকর্ষের টানে একে অপরের কাছে এসে বাইনারি সিস্টেম তৈরি করতে পারে।

বাইনারি স্টার সিস্টেম কেন গুরুত্বপূর্ণ? এই সিস্টেমগুলো জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য একটি সোনার খনি! কেন জানেন? কারণ, এদের কক্ষপথ এবং গতি পর্যবেক্ষণ করে আমরা তারার ভর, আকার, এবং এমনকি তাদের জীবনচক্র সম্পর্কে জানতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, নোভা বা সুপারনোভার মতো বিস্ফোরণ প্রায়ই বাইনারি সিস্টেমে ঘটে, যখন একটি তারা তার সঙ্গীর কাছ থেকে পদার্থ সংগ্রহ করে। এই ঘটনাগুলো মহাবিশ্বের রাসায়নিক বিবর্তন বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

চলুন, কয়েকটি বিখ্যাত বাইনারি স্টার সিস্টেমের নাম জেনে নিই!

প্রথমে আসি সিরিয়াস। এটি ক্যানিস মেজর নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত। সিরিয়াস এ এবং সিরিয়াস বি নামে দুটি তারা মিলে এই বাইনারি সিস্টেম গঠন করে। সিরিয়াস এ হলো একটি উজ্জ্বল মূল-ক্রম তারা, আর সিরিয়াস বি হলো একটি শ্বেত বামন। এটি রাতের আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা হিসেবে পরিচিত!

এরপর রয়েছে আলফা সেন্টাউরি। এটি আমাদের সূর্যের সবচেয়ে কাছের তারা ব্যবস্থা। আলফা সেন্টাউরি এ এবং বি নামে দুটি তারা এই বাইনারি সিস্টেমের অংশ। এরা সেন্টাউরাস নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৪.৩৭ আলোকবর্ষ দূরত্ব রয়েছে।

তৃতীয়ত, আমরা কথা বলবো আলবিরিও নিয়ে। এটি সিগনাস নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত একটি অপূর্ব বাইনারি সিস্টেম। আলবিরিওর একটি তারা সোনালি হলুদ, আর অন্যটি নীলাভ। টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলে এদের রঙের বৈপরীত্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর!

আরেকটি উল্লেখযোগ্য সিস্টেম হলো মিজার এবং আলকর। এটি ইউরসা মেজর নক্ষত্রমণ্ডলে বিগ ডিপারের অংশ। মজার ব্যাপার হলো, এটি শুধু একটি বাইনারি সিস্টেম নয়, এটি একটি একাধিক তারা ব্যবস্থার অংশ, যেখানে মিজার নিজেই দুটি তারা নিয়ে গঠিত!

ছবি: istock

Post a Comment

মন্তব্য করতে পারেন

Previous Post Next Post