টেলিস্কোপের লেন্সে ধরা পড়া আইনস্টাইন রিং

আইনস্টাইন রিং

বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ও ব্যয়বহুল মহাকাশ টেলিস্কোপ, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST), সম্প্রতি মহাবিশ্বের একটি চিত্তাকর্ষক ও বিরল দৃশ্য ধরা পড়েছে, যা বিজ্ঞানীদের মাঝে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। এই ছবিতে ধরা পড়েছে একটি আইনস্টাইন রিং, যা প্রথম নজরে আকাশে ভাসমান একটি ভৌতিক, সুন্দর বলয়ের মতো মনে হয়। কিন্তু এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের পেছনে রয়েছে মহাকর্ষের অবিশ্বাস্য শক্তি এবং দুটি পৃথক ছায়াপথের সমন্বয়।

আইনস্টাইন রিং হলো এমন একটি মহাজাগতিক ঘটনা, যা আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা করা যায়। এই ঘটনাটি ঘটে যখন দুটি ছায়াপথ বা মহাজাগতিক বস্তু প্রায় একই সরলরেখায় অবস্থান করে, এবং সামনের ছায়াপথটির শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র পেছনের ছায়াপথ থেকে আসা আলোকে বাঁকিয়ে দেয়। এই মহাকর্ষীয় লেন্সিং (Gravitational Lensing) প্রভাবের ফলে পেছনের ছায়াপথের আলো একটি প্রায় নিখুঁত বলয়ের আকারে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। এই ঘটনার নামকরণ করা হয়েছে আইনস্টাইনের নামে, কারণ তিনিই প্রথম এই ধরনের মহাকর্ষীয় প্রভাবের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে উৎক্ষেপণের পর থেকে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের গভীরতম রহস্য উন্মোচন করে চলেছে। এর অত্যাধুনিক ইনফ্রারেড ক্যামেরা এবং অতি সংবেদনশীল সেন্সরগুলো দূরবর্তী ছায়াপথ, নক্ষত্র গঠন এবং এমনকি প্রাচীন মহাজাগতিক ঘটনাগুলোর অভূতপূর্ব ছবি তুলে এনেছে। আইনস্টাইন রিং-এর এই সাম্প্রতিক ছবিটি জেমস ওয়েবের অতুলনীয় ক্ষমতার আরেকটি প্রমাণ। এই ছবিতে ধরা পড়া বলয়টি শুধু দৃষ্টিনন্দনই নয়, বরং এটি বিজ্ঞানীদের মহাবিশ্বের গঠন, ছায়াপথের বিবর্তন এবং মহাকর্ষীয় লেন্সিং-এর প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন তথ্য সরবরাহ করছে।

জেমস ওয়েবের ধরা এই আইনস্টাইন রিং-এর ছবিতে দেখা যায় একটি উজ্জ্বল, প্রায় নিখুঁত বৃত্তাকার বলয়, যা দুটি ছায়াপথের মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল। সামনের ছায়াপথটির বিশাল মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র পেছনের ছায়াপথের আলোকে বিকৃত করে এই অপূর্ব দৃশ্য সৃষ্টি করেছে। ছবিটি এতটাই স্পষ্ট যে বিজ্ঞানীরা এর মাধ্যমে দুটি ছায়াপথের গঠন, দূরত্ব এবং এমনকি তাদের গঠনকারী তারকা ও গ্যাসের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করতে পারছেন। এই ধরনের পর্যবেক্ষণ মহাবিশ্বের বড় আকারের গঠন এবং অন্ধকার পদার্থের (Dark Matter) ভূমিকা বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আইনস্টাইন রিং শুধু একটি দৃষ্টিনন্দন মহাজাগতিক দৃশ্য নয়, এটি বিজ্ঞানীদের জন্য একটি জানালা যা মহাবিশ্বের অতীত ও বর্তমানের গল্প বলে। এই ঘটনা আমাদের মহাকর্ষের প্রকৃতি, ছায়াপথের গঠন এবং এমনকি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সম্পর্কে গভীর ধারণা দেয়। জেমস ওয়েবের মতো টেলিস্কোপের মাধ্যমে এই ধরনের বিরল ঘটনা পর্যবেক্ষণের ফলে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের গঠন ও বিবর্তনের নতুন মডেল তৈরি করতে পারছেন।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ধরা আইনস্টাইন রিং-এর এই ছবি শুধু একটি মহাজাগতিক শিল্পকর্ম নয়, বরং এটি মানুষের জ্ঞানের সীমানা প্রসারিত করার একটি মাধ্যম। এই ভৌতিক বলয়টি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মহাবিশ্ব কতটা বিস্ময়কর এবং রহস্যময়। জেমস ওয়েবের মতো প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা এই রহস্যের আরও গভীরে প্রবেশ করতে পারছি, এবং হয়তো একদিন মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাব।

ছবি: jwst/nasa

Post a Comment

মন্তব্য করতে পারেন

Previous Post Next Post