মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্ধকার অতীত

রাতের আকাশে যখন আমরা তাকাই, তখন ওই আলোর রেখাটি আমাদের মন মুগ্ধ করে তোলে। এটি আমাদের বাড়ি, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। বিশাল, শান্ত, আর অসীম তারাদের এক সমাহার। কিন্তু কী হবে যদি বলি, এই শান্ত, সুন্দর গ্যালাক্সিরও আছে এক অন্ধকার, হিংস্র অতীত?


মহাকাশে গ্যালাক্সিরা কেবল স্থির বস্তু নয়, যেন জীবন্ত প্রাণীর মতো। সময়ের সাথে সাথে তারা জন্ম নেয়, বড় হয়, এমনকি তাদের আকৃতিও বদলায়। আর অনেক সময়, বড় গ্যালাক্সিরা ছোট গ্যালাক্সিকে নিজের অংশ করে নেয়, সহজ ভাষায় বলতে গেলে - গিলে ফেলে! এই প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানীরা বলেন 'গ্যালাক্টিক ক্যানিবালিজম' বা গ্যালাক্সিদের নরমাংস ভক্ষণ।

হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও, আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে আজকের এই সুবিশাল আর সুগঠিত আকারে পৌঁছাতে অতীতে অনেক ছোট ও দুর্বল গ্যালাক্সিকে গিলে খেয়েছে। ভাবুন তো, কতটা মহাজাগতিক সংঘর্ষ আর আত্মসাৎ-এর মধ্য দিয়ে আমাদের ছায়াপথ আজ এই অবস্থায় এসেছে! এটা ঠিক যেন একটা বড় মাংসাশী প্রাণী তার শিকারকে গিলে ফেলার মতো। বড় গ্যালাক্সির প্রবল মহাকর্ষ বল ছোট গ্যালাক্সিকে নিজের দিকে টেনে নেয়, ছিন্নভিন্ন করে দেয় তার তারকা, গ্যাস, আর ধুলোর শরীর, এবং অবশেষে সেগুলোকে নিজের অংশ করে নেয়।

এই গল্পটা কেবল অনুমান নয়, বিজ্ঞানীরা এর প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার গাইয়া (Gaia) মহাকাশযান বিলিয়ন বিলিয়ন তারার অবস্থান আর গতিপথ রেকর্ড করেছে। আর গাইয়ার পাঠানো বিপুল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করেই বিজ্ঞানীরা এই অবিশ্বাস্য সত্যিটা জানতে পেরেছেন। তারা দেখেছেন আমাদের মিল্কিওয়ের মধ্যে এমন সব তারার স্রোত বা স্টার স্ট্রিম (Star Stream) রয়েছে, যাদের রাসায়নিক গঠন আর গতিপথ মিল্কিওয়ের নিজস্ব তারাদের থেকে আলাদা। এই তারাগুলো আসলে অতীতে গিলে ফেলা ছোট গ্যালাক্সিগুলোর ধ্বংসাবশেষ।

গাইয়ার তথ্য বলছে, মিল্কিওয়ে তার ইতিহাসে অন্তত ৫ থেকে ১৫টি ছোট গ্যালাক্সিকে গিলে ফেলেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর যার প্রমাণ সবচেয়ে স্পষ্ট, সেটির নাম দেওয়া হয়েছে "গাইয়া-এনসেলাডাস" (Gaia-Enceladus)। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর আগে, যখন মিল্কিওয়ে তারুণ্যে ছিল, তখন গাইয়া-এনসেলাডাস নামের একটি তুলনামূলক বড় বামন গ্যালাক্সি (Dwarf Galaxy) মিল্কিওয়ের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

এই সংঘর্ষটি ছিল বিশাল আকারের। এটি কেবল কিছু তারাকে মিল্কিওয়ের অংশে যোগ করেনি, বরং এটি আমাদের ছায়াপথের গঠনকেই বদলে দিয়েছে। সংঘর্ষের ফলে মিল্কিওয়ের কেন্দ্রীয় অংশ, যাকে বাল্জ (Bulge) বলা হয়, তার আকৃতি পাল্টে যায়। নতুন তারার জন্ম হয় এবং মিল্কিওয়ের নিজস্ব তারাদের সাথে গাইয়া-এনসেলাডাসের তারাগুলো মিশে যায়। এই কারণেই আজ মিল্কিওয়ের তারকা জনসংখ্যার মধ্যে এত বৈচিত্র্য দেখা যায়। অনেকটা যেন পুরনো ক্যানভাসে নতুন রঙ আর টেক্সচার যোগ করা হলো, যা ছবিটাকে আরও জটিল আর সুন্দর করে তুলেছে।

আর এই ক্যানিবালিজম কেবল অতীতের গল্প নয়, এটি আজও ঘটছে! স্যাজিটারিয়াস ডোয়ার্ফ এলিপটিক্যাল গ্যালাক্সি (Sagittarius Dwarf Elliptical Galaxy) নামের একটি ছোট গ্যালাক্সি বর্তমানে মিল্কিওয়ের মহাকর্ষীয় টানে আটকা পড়েছে এবং ধীরে ধীরে ছিন্নভিন্ন হয়ে আমাদের গ্যালাক্সির অংশে পরিণত হচ্ছে। এটি যেন আমাদের চোখের সামনেই ঘটে চলা এক মহাজাগতিক খাবার-দৃশ্য! স্যাজিটারিয়াস থেকে আসা তারার স্রোত মিল্কিওয়ের চারপাশে বিশাল এক স্ট্রিম তৈরি করেছে যা বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করছেন।

এই গিলে খাওয়ার প্রক্রিয়াগুলো কেবল গ্যালাক্সির আকারই বাড়ায় না, বরং এর ভেতরের অনেক কিছুকেই প্রভাবিত করে। গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের ভর বৃদ্ধি পেতে পারে, তারকাগুচ্ছ তৈরির প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়, এমনকি গ্যালাক্সির অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটারের (Dark Matter) বণ্টনও বদলে যায়। সহজ কথায়, এই সংঘর্ষগুলো গ্যালাক্সিকে ঝাঁকিয়ে দেয়, নতুন শক্তি যোগায় এবং তার বিবর্তনের পথকে নতুন দিকে চালিত করে। মহাবিশ্বে বেশিরভাগ বড় গ্যালাক্সিই সম্ভবত এইভাবেই ছোটদের গিলে খেয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে। এটি গ্যালাক্সির বিবর্তনের এক অপরিহার্য অংশ।

সুতরাং, আজকের এই বিশাল, উজ্জ্বল আর গৌরবময় মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি আসলে তার অতীতের রক্ত-মাংসে গড়া। অসংখ্য ছোট গ্যালাক্সির মৃত্যু আর তাদের শরীর সংহত হওয়ার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে আমাদের প্রিয় ছায়াপথের বর্তমান রূপ। যখন রাতের আকাশে মিল্কিওয়ের দিকে তাকাবেন, তখন মনে রাখবেন এর প্রতিটি তারা, প্রতিটি গ্যাসকণা হয়তো বহু কোটি বছর আগে অন্য কোনো ছোট্ট গ্যালাক্সির অংশ ছিল, যা আজ আমাদের বাড়ির অংশ হয়ে গেছে। মহাজাগতিক বিবর্তনের এ এক অসাধারণ, আর কিছুটা ভয়ঙ্কর গল্প।

Post a Comment

মন্তব্য করতে পারেন

Previous Post Next Post