সময় কি সত্যিই একটি বিভ্রম? – পদার্থবিজ্ঞানের চোখে সময়ের রহস্য


সময়—যা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নিরবিচারে প্রবাহিত হয়, ঘড়ির কাঁটার মতোই নিশ্চিত ও একমুখী বলে মনে হয়। কিন্তু আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান বলছে, সময় হয়তো আমাদের চেতনার এক বিভ্রমমাত্র। নিউটনের ধ্রুব ও সার্বজনীন সময়ের ধারণা উল্টে দিয়েছেন আইনস্টাইন, যিনি দেখিয়েছেন সময় হচ্ছে আপেক্ষিক—যা একাধিক পর্যবেক্ষকের জন্য ভিন্নভাবে প্রবাহিত হতে পারে। তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাকর্ষ ক্ষেত্রের শক্তির ওপর ভিত্তি করে সময় ধীরে বা দ্রুত প্রবাহিত হতে পারে। এ কারণেই পৃথিবীর পৃষ্ঠে সময় যেমন চলে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকা একজন নভোচারীর ঘড়িতে তেমনভাবে চলে না।

তবে সময়কে শুধু আপেক্ষিক বললেও পুরো রহস্য ফুরায় না। কিছু তত্ত্ব দাবি করে সময় বাস্তবেই হয়তো অস্তিত্বহীন। পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক সমীকরণগুলো সময়কে একটি পরিমাপ হিসেবে নেয়, কিন্তু সেখানে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ আলাদা কিছু নয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও থার্মোডাইনামিক্স-এর সূত্রগুলো সময়কে নির্দিষ্ট গতিতে প্রবাহিত করতে বাধ্য না। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র বলছে, একটি সিস্টেমের বিশৃঙ্খলা (এনট্রপি) সময়ের সঙ্গে বাড়ে, আর এটাই সময়ের একমুখী প্রবাহের সবচেয়ে জোরালো ব্যাখ্যা।

বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী কারলো রোভেল্লি মনে করেন, সময় হয়তো বাস্তব জগতের গুণ নয়, বরং আমাদের উপলব্ধির একটি মানদণ্ড। এমনকি মহাজাগতিক স্কেলে ‘বর্তমান’ বলে কিছু নেই, কারণ আলো সীমিত গতিতে চলে। তাই আপনি যে নক্ষত্রটি আজ রাতে দেখছেন, সেটির আলো আসতে হয়তো এক লক্ষ বছর সময় লেগেছে, ফলে আপনি তার বর্তমান নয়, অতীত দেখছেন।

আজকের এই আধুনিক যুগেও সময়ের প্রকৃতি নিয়ে বিজ্ঞানীরা একমত নন। স্ট্রিং থিওরি, লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি কিংবা মাল্টিভার্স তত্ত্বের ভেতরেও সময়ের রূপ বদলে যায়। কোনো কোনো মডেলে সময় উল্টো ঘুরে যেতে পারে, আবার কিছু তত্ত্বে সময় কেবলই একটি সংখ্যা, কোনো বাস্তব প্রবাহ নয়।

এই সব প্রশ্ন আমাদের সময়কে ভিন্নভাবে ভাবতে শেখায়। সময় কি শুধুই ঘড়ির কাঁটার শব্দ, না কি মহাবিশ্বের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য গাণিতিক গঠন? আমরা কি সত্যিই সময় বয়ে চলছি, না কি সময় আমাদের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তো আগামী দিনের গবেষণাই দিতে পারবে। তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, সময় কেবল ক্যালেন্ডার আর ঘড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো বাস্তবতা নয়, বরং এটি হলো মহাবিশ্বের রহস্যময় এক চাবিকাঠি, যার মানে আমরা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি।

Post a Comment

মন্তব্য করতে পারেন

Previous Post Next Post